ওয়াহাবি শুদ্ধিকরণ আন্দোলন
তন্ময় ভট্টাচার্য, দৈনিক যুগশঙ্খ, শিলচর, ১৫ জুলাই ২০১৬, শুক্রবার, পৃষ্ঠা-৬ (পরিমার্জিত)
Wahabi Cleansing Movement
Tanmoy Bhattacharya, Dainik Jugasankha, Silchar, 15 July 2016, Friday, page-6 (Adapted)
ভূমিকা (Introduction) :-
ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে, 'ধর্মনিরপেক্ষ' ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মমত কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম নয় । এ দেশে সনাতন ধর্মে যাঁরা বিশ্বাস রাখেন তাঁরা আসলে আবহমান কাল ধরে চলে আসা হিন্দু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস রাখেন । যে সংস্কৃতি কোনও ধর্মীয় মতকে একমাত্র মত বলে প্রচার করতে পারে না । সনাতন ধর্মের কোনও প্রতিষ্ঠাতা নেই । এর আবহমানতাই একে একটি প্রতিষ্ঠা দিয়েছে । এর ফলে যে-অর্থে ইস্লাম ও খ্রিস্টধর্ম আমাদের কাছে ধর্ম বলে জ্ঞাত, সেই বিশ্লেষণে হিন্দুধর্মকে ধর্ম বলা যাবে না ।
অন্য দিকে ইস্লাম একটি রাজনৈতিক ধর্ম, এর রাজনৈতিক চেহারা কেউই ঢাকার চেষ্টা করে না । হজরত মোহম্মদ নিজে একাধারে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, দক্ষ শাসক ও যুদ্ধ পরিচালক । তাই ইস্লাম ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করে দেখে না । দুটি ইস্লামি গোষ্ঠী, শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ দেড় হাজার বছর ধরেই অব্যাহত । ধর্মীয় উদ্দেশে অস্ত্রধারণ করা ইস্লাম ধর্মের কট্টরপন্থীদের কাছে নতুন কিছু নয় ।
ইস্লাম ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব (Islam & family feuds) :-
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে (সম্ভবত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে) হজরত মোহম্মদের জন্ম হয় মক্কার হাসেম বংশে ও তাঁর দিব্যজ্ঞান লাভ হয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে । ওঁনার মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে । হজরত মোহম্মদের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন আবু সুফিয়ান । এরা একই গোষ্ঠীর । কিন্তু কাবার তীর্থক্ষেত্রের অধিকার নিয়ে দুই প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব একসময় বিরাট যুদ্ধ ডেকে আনল । মোহম্মদের পূর্বপুরুষ ছিলেন হাশেম ও আবু সুফিয়ানের পূর্বপুরুষ উমাইয়া । এই হাশেম ও উমাইয়া সম্পর্কে কাকা-ভাইপো । এই তীব্র পারিবারিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ইস্লামের ইতিহাস । এই দ্বন্দ্ব ইস্লামকে আর ছেড়ে যায়নি । ৬৩০ সালে মোহম্মদের প্রবর্তিত ইস্লাম ধর্মে উদ্দীপিত হয়ে মোহম্মদের নেতৃত্বে এক ছোট দল উমাইয়া নেতা আবু সুফিয়ানকে পরাজিত করে মক্কার প্রধান তীর্থ কাবা দখল করে । এই বিজয়ের পর হজরত মোহম্মদ দৃঢ় প্রত্যয়ে একেশ্বরবাদের প্রচারকে মহাসংগ্রামে পরিণত করলেন । মোহম্মদের মৃত্যুর ২১ বছর পরে খলিফা আলিকে কুটনৈতিক যুদ্ধে হারিয়ে আবু সুফিয়ানের পুত্র মুবাইয়া আবার ইস্লাম বিশ্বের ক্ষমতা দখল করেন । এই বংশের রাজত্ব চলে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । আরেক নৃশংস অভিযানে উমাইয়াদের উৎখাত করে হাশেম বংশীয় আবাসীয় রাজারা ক্ষমতা অধিকার করে । ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের হাতে আরবদের রাজত্ব চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । এরপর আরবরা আর রাজশক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি । কিন্তু ধর্ম হিসেবে ইস্লাম বিস্তার লাভ করে ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে । ভারতবর্ষে কিন্তু ইস্লাম রাজশক্তি হিসেবে দেখা দেয়, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব দিকে ।
ওয়াহাবি শুদ্ধিকরণ আন্দোলন (Wahabi Cleansing Movement) :-
অষ্টাদশ শতকে আরব দেশে ইস্লাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের নামে ইস্লামকে বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত করে তোলার এক প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে । আব্দুল ওয়াহাবের পুত্র মোহম্মদ ইবন আবদাল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২) এই শুদ্ধি আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন । ওয়াহাবি আন্দোলনের আগেও শুদ্ধিকরণ আন্দোলন ছিল । কিন্তু ওই সব আন্দোলন কিছু অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল । ওয়াহাবিরা ইস্লামের সুন্নি সম্প্রদায়ের, এরা ধর্মীয় চিন্তায় অসম্ভব কট্টর । এরা কেতাবী তাত্ত্বিক ও ধর্মগ্রন্থে লেখা নির্দেশ ছাড়া কিছুই মানে না । এরা ইস্লামের স্থপতি হজরত মোহম্মদের সমাধিস্থল স্মৃতিস্তম্ভ ইস্লাম ধর্ম-বিরোধী বলে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল । ওয়াহাবিদের মতে একজন মুসলমান কেবল ধর্মকে স্বীকার করলেই চলবে না, তাকে পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে ইস্লাম ধর্মবাচক সব প্রতীক বহন করে চলতে হবে যাতে অমুসলমান থেকে আলাদা করে তাকে স্পষ্ট চেনা যায় ।
ওয়াহাবিদের কাছে অবশ্য মুসলমান বলতে শুধুই সুন্নি মুসলমান, শিয়ারা তাদের কাছে চরম শত্রু । কারণ শিয়াদের কথা তো কোরানে লেখা নেই । ১৮০১ সালে ওয়াহাবিরা বাগদাদে হুসেনের সমাধির ওপর ধ্বজা ভেঙ্গে দিয়েছিল অনৈস্লামিকতার প্রতীক বলে । সেইসঙ্গে ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছিল । হুসেন হজরত মোহম্মদের নাতি আর শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে অতি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি । শিয়া সম্প্রদায় ওয়াহাবি পন্থা মানে না, তবে শিয়াদের নিজস্ব কট্টরপন্থীরা আছে ।
সৌদি আরব ও ওয়াহাবি আন্দোলন (Saudi Arab & Wahabi Movement) :-
সৌদি রাজাদের পূর্বপুরুষ একসময় আরবের হেজাজ প্রদেশের মরুভূমির এক কোণায় এক ছোট্ট জায়গার শেখ ছিল । ওয়াহাবিদের শিষ্য হয়ে ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে বিশাল অঞ্চল দখল করে ফেলল, আজ যাকে আমরা সৌদি আরব বলি । এর মধ্যে মক্কা-মদিনার মতো তীর্থস্থানও আছে । এদের তুর্কি সম্রাটরা মোটেই পছন্দ করত না । তখন তুর্কি সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু সময় । প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এদের স্বীকৃতি দেয় । ওয়াহাবি ধর্ম সৌদি আরবে স্বীকৃত ধর্ম । তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ায় সৌদি আরব স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয় । আজও আধুনিক তুরস্ক ওয়াহাবিদের স্বীকার করে না । তবে এদের সৌদি আরবের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক আছে ।
ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাব (Influence of Wahabi Movement in Indian subcontinent) :-
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই ভারতের ইস্লামপন্থীদের মধ্যে এই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে । আগে বাংলার মুসলমানরা নিজেদের ইস্লাম নামকরণে এত কট্টরভাবে আরবি-ফার্সি নাম ব্যবহার করত না । কেবল নামে হিন্দু কি মুসলমান অনেক সময় বোঝাই যেত না । একটি উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি ছিল উত্তরবঙ্গের এক গ্রাম পতিসরে । সেই গ্রামের মালির নাম ছিল রূপচাঁদ প্রামাণিক, ধর্মে সে ছিল মুসলমান । তার পুত্র এই ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাবে হয়ে গেল ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ । মোটামুটিভাবে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় নামকরণে আরবি-ফার্সির ব্যবহার বেশি ছিল না । এই আন্দোলন তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, ধর্মীয় সংস্কার ও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিপুল পরিবর্তন এনে দিল । এই ওয়াহাবি শুদ্ধিকরণের প্রভাবে ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি আরও সহজ হয়ে উঠেছিল ।
উপসংহার (Conclusion) :-
গত কয়েক দশকে আরবের এই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগ্রামের বিশ্বায়ন ঘটেছে । বর্তমানে "শান্তি দূরদর্শন", সোশাল মিডিয়া ও সস্তার চাইনিজ্ স্মার্টফোনের বদান্যতায় পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে ওয়াহাবি প্রভাব বাড়ছে । মগজধোলাই হয়ে ঐস্লামিক ধর্মসংগ্রামী/জেহাদিদের অনেকেই বেহেস্তে যাবার জন্য অবধারিত মৃত্যুকে বরণ করতে দ্বিধা করে না । মুশকিল হচ্ছে, ওইসব বেহেস্তকামীরা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর সঙ্গে আজকের এই একবিংশ শতাব্দীকে পৃথক করে দেখে না । মগজধোলাই এবং অনেক ক্ষেত্রেই ক্যাপটাগন (Captagon or IS drug) নামক এক মাদক সেবন করার পর এরা আর নম্র ধর্মাচারী থাকে না, হয়ে ওঠে নির্মম কাফের জবাই করার জম্বি (zombie'র স্থলে পশু শব্দ ব্যবহার করলে পশুদের অপমান করা হয়) । সারা বিশ্বে ইস্লামি জঙ্গি হানার পেছনে সর্বত্রই ওয়াহাবি চিন্তাধারা কাজ করছে । গান্ধিজী বলতেন 'চোখের বদলে চোখ' এই নীতি মানলে সারা বিশ্ব একদিন অন্ধ হয়ে যাবে । এরা বিশ্বকে এরকম অন্ধত্বের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে ।
Reference :-
"Islam in the World", 2006 by Malise Ruthven, Oxford University Press; 3rd edition."A Literary History of the Arabs", 1907 by R.A. Nicholson.
এক কাফের বা মালাউনের সংযোজন (Addition from an idol worshipping infidel) :-
আর কত বছর আমরা, অর্থাৎ পৌত্তলিক বাঙ্গালী হিন্দুরা, আরশোলার মত বেঁচে থাকব ? আমাদের অস্তিত্ব এই ওয়াহাবিদের (সালাফিদের) কাছে অসহ্য । তাই আসুন -
১) আমরা সবাই দলে দলে সালাফি হয়ে যাই অথবা
২) গণিমতের মাল হিসেবে আমাদের মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যাদের ওদের হাতে সমর্পণ করে নিজেরা জবাই হয়ে যাই যেমন হয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সনে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আয়ুব খানের হাতে পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশ) ।
No comments:
Post a Comment