গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ : বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার, ১৯৭২-১৯৭৪
১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশে) পশ্চিম পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র: অষ্টম খণ্ড’ থেকে ।
--x--
পৃঃ১৭ : ইব্রাহিম ভূইয়া - লাইব্রেরীয়ান, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৮-৬-১৯৭৪
১৯৭১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমি গ্রামের বাড়ী যাওয়ার জন্য ঢাকা সদরঘাটের দিকে রওয়ানা হয়েছিলাম । সদরঘাট টার্মিনালের প্রবেশপথে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনাদের প্রহরায় মোতায়েন দেখলাম । কিছুক্ষণ পরে এক অতি বৃদ্ধ ভদ্রলোক মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার জন্য টার্মিনালে আসলেন । সঙ্গে তার নবপরিণিতা পুত্রবধূ এবং যুবতী মেয়ে ছিল । পাঞ্জাবী সেনারা আমাদের সবাইকে তল্লাশি করতে বললো, "ইয়ে দো আওরাত নাহি যায়েগী" (এই দুই মহিলা যাবে না) । বৃদ্ধ নিরূপায় হয়ে কান্নাকাটি করে সামনে যাকে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, "আপনারা আমার মেয়ে ও পুত্রবধূকে বাঁচান ।" কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না । ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই অসহায় যুবতী মেয়ে দুজন রক্ষা করার জন্য কোন কথা বলতে পারি নাই, কিছুই করতে পারি নাই । আমাদের সকলের চোখের সামনে পাঞ্জাবী সেনারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে যুবতী মেয়ে দুটিকে টেনে হেঁচড়িয়ে ওদের আর্মি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল । মেয়ে দুটি এ সময় করুণ আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়েছিল । দু'ঘন্টা পর আবার যুবতী মেয়ে দুটিকে ফিরিয়ে নিয়ে এল । দেখলাম মেয়ে দুটির চলার চলার কোন শক্তি নেই, এলোমেলো চুল, অশ্রু ভরা মুখমণ্ডল । আমরা লঞ্চে রওয়ানা হয়ে গেলাম । 'পাগলার' এম. এম. ওয়েল পাক আর্মি ঘাঁটিতে আমাদের লঞ্চ আটকিয়ে তল্লাশি চালানো হয় - পাকসেনারা যাত্রীদের মূল্যবান মালামাল লুট করে নিয়ে যায় । লঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম - ওদের কামরার জানালার সম্মুখে চারটি বাঙ্গালী যুবতী মেয়ে এলোমেলো চুলে করুণ ও অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে । জানালা দিয়ে তাদের দেহের যতটুকু দেখা গেল তাতে মনে হলো তাদেরকে বিবস্ত্র করে রাখা হয়েছে । বুড়ীগঙ্গা নদীতে ১৫-২০ জন করে এক সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঙ্গালী যুবকদের বহু লাশ ভাসতে দেখলাম ।
১৯৭১ সনের অক্টোবর মাসের একদিন আমি বাড়ীতে ছিলাম । সকাল নয়টার সময় আমি বাগড়া বাজারে গিয়েছিলাম বাজার করতে । বহু লোকের সমাগম ছিল । বাজারের দক্ষিণ দিকে পদ্মা নদী । পূর্বের দিন সন্ধ্যায় পাক সেনাদের নোঙ্গর করা স্টিমারটি পদ্মারঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছিল - স্টিমারের চারিদিকে সশস্ত্র পাকসেনারা প্রহরায় মোতায়েন ছিল । অকস্মাৎ দেখলাম পাকসেনারা স্টিমার থেকে সজোরে টেনে একটি লাশ ফেলে দিচ্ছে - স্টিমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর আমরা নৌকা নিয়ে গিয়ে দেখলাম এক ক্ষত-বিক্ষত যুবতীর বীভৎস উলঙ্গ লাশ । এছাড়া কাশবনের পাড়ে পড়ে আছে ফুলা বীভৎস লাশের গালে ও দেহের অন্যান্য স্থানে ক্ষত চিহ্ন দেখলাম । তাঁর ডান দিকের স্তনের বোটা তুলে নেয়া হয়েছে ।
--x--
পৃঃ২২ : আবদুল কুদ্দুস মিয়া - রিজার্ভ ইন্সপেক্টর অব পুলিশ, বি.আর.পি হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ, ঢাকা, ২৬-৩-১৯৭৪
১৯৭১ সনের ১৫ মে থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের জমায়েত করা হয় । পাঞ্জাবী পুলিশ লাইনে এসেই আমাদের সাথে যথেচ্ছা ব্যবহার আরম্ভ করে দেয়; কথায় কথায় পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা আমাদের বুটের লাথি ও বন্দুকের বাট দিয়ে পিটাতে থাকে, চোখ রাঙ্গিয়ে বলতে থাকে "শুয়ারকা বাচ্চা, হিন্দুকা লাড়কা, বেইমান শালা লোগ, হামলোগ আদমী নাহি মাংতা, জামিন মাংতা" (শুয়োরের বাচ্চা, হিন্দুর ছেলে, বেইমান শালা লোক, আমরা লোক চাই না, জমি চাই - [we don't want the people, we want the land - Yahya Khan]) । আমাদেরকে হেডকোয়ার্টারের সকল কক্ষ থেকে কুকুর বিড়ালের মত তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের জায়গা দেওয়া হয়, আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, কাপড়, আসবাবপত্র সব বাইরে ফেলে দেওয়া হয়, আমরা অসহায়ের মত দেওয়া হয়, আমাদের আসবাবপত্র তুলে নিয়ে আস্তাবলের সামনে, ব্যারাকের বারান্দায় আশ্রয় গ্রহণ করি ।
পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ রাজারবাগ আসার পরই বাঙ্গালীদের উপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে । প্রতিদিন "ইয়ে শালা লোগ মুক্তি হ্যায়" বলে বহু নিরীহ বাঙ্গালী যুবককে চোখ বেঁধে মিলিটারী ট্রাক ও জীপ থেকে আমাদের চোখের সামনে নামিয়ে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর তলায় নিয়ে রাখা হয় । সারাদিন এভাবে চোখ বেঁধে বাঙ্গালী যুবকদের রাজারবাগ এনে জমায়েত করা হয় এবং সন্ধ্যার পর এ সব অসংখ্য বাঙ্গালী যুবককে মিলিটারী ট্রাকে করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে হত্যা করা হয় । হেডকোয়ার্টারের তেতলা ও চারতলায় বহু যুবতী মেয়েকে উলঙ্গ করে রাখা হয় - পাঞ্জাবী সেনা ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এসব ধরে আনা বালিকা ও মহিলাদের উপর অবিরাম ধর্ষণ চালায় । লাইনে পুলিশের কলরবের জন্য আমরা অত্যাচারিত মেয়েদের ক্রন্দন রোল শুনতে পেতাম না - লাইনের দূরে গিয়ে দাঁড়ালেই ধর্ষিতা মেয়েদের আর্তনাদ ও আহাজারি শুনতে পেতাম - রাতে ধর্ষিতা মেয়েদের বুকফাটা চিৎকারে আমরা কোয়ার্টারে ঘুমাতে পারতাম না - সারা রাত পরিবার পরিজন নিয়ে জেগে থাকতাম । হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা ধর্ষিতা মেয়েদের আর্তনাদে আমরা বাঙ্গালী মেয়েদের দুর্দশা দেখে দুঃখে, ক্ষোভে, বেদনায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম । আমরা ঐ সকল অসহায় মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য কিছুই করি নাই, করতে পারি নাই, কারণ ওদেরকে উদ্ধার করার জন্য, ওদের অত্যাচারে সহানুভূতি ও দরদ দেখানোর কোন সুযোগ আমাদের ছিল না । হেডকোয়ার্টারের তেতলা ও চারতলায় যেখানে বাঙ্গালী মেয়েদের উলঙ্গ অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখে ধর্ষণ করা হতো সেখানে সব সময় পাঞ্জাবী সৈন্যরা প্রহরায় মোতায়েন থাকতো । সেখানে আমাদের প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না ।
মিঃ বোস্তান খাঁ নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক এ সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর ছিলেন । এই ভদ্রলোক আমাদের লাইনের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আমাদের উপর সর্বদিক দিয়ে অত্যাচার ও দমননীতি আরম্ভ হয়ে যায় । পুলিশ লাইনে কখন আমাদের উপর মৃত্যুর কড়ালগ্রাস নেমে আসে, আমরা এভয়ে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতাম । ১৯৭১ সনের ৪ঠা এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে তৎকালীন স্টোর ইনচার্জ পুলিশ সার্জেন্ট মিঃ মর্তুজা হোসেন এবং সুবেদার আবুল হোসেন খান এবং সুবেদার মোস্তফাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে পাঞ্জাবী সেনারা এই তিনজন বাঙ্গালী পুলিশকে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার চালায় - পাঞ্জাবী সেনারা লাইন হয়ে ওদেরকে ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে ফুটবলের মত বুট দিয়ে লাথি মেরে খেলতে থাকে । ওদের তিনজনের দেহ লাঠি, বেত, বুট ও বেয়নেট দিয়ে গরুর মত পিটিয়ে চুরমার করে দেওয়া হয়, সারা দেহ চাক চাক করে কেটে দেওয়া হয় । ওদের দেহ রক্তাক্ত হয়ে একেবারে অবশ ও অচল হয়ে গেলে তাদের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় । ওদের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ দেখে যাকে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই পাঠান তাদেরকে ছেড়ে দেন । পদস্থ পাঞ্জাবী অফিসারদের তাদের হত্যা করার জন্য তিনটি ফাঁকা গুলির শব্দ শুনিয়ে দেয় এবং বন্দীদের বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকার জন্য বলা হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি উপরোক্ত তিন সহকর্মীর নিকট উক্ত ঘটনা বিস্তারিত জানতে পেরেছি ।
১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে ঢাকা রাজধানীতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানের মুখে আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও পাঞ্জাবী সেনাদের বেসামাল অবস্থা দেখতে পাই । বাংলাদেশ মুক্ত হলে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীরাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও পাঞ্জাবী সেনাদের বন্দী করে নিয়ে যায় ।
--x--
পৃঃ২৪-২৮ : সুবেদার খলিলুর রহমান - আর্মস এস.আই., বি.আর.পি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা, ২-৬-১৯৭৪
১৯৭১ সনের ২৯শে মার্চ সকাল দশটায় আমরা মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে উপস্থিত হয়ে আমাদের প্রিয় পুলিশ মিঃ ই.এ. চৌধুরী, পুলিশ কমান্ডেন্ট মিঃ হাবিবুর রহমান, ডি.এস.পি. লোদী সাহেব, রেঞ্জ রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মিঃ সৈয়দ বজলুল হক, ডি.এস.পি. আব্দুস সালাম, রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মিঃ মতিয়ুর রহমান সবাইকে উপস্থিত দেখলাম । মিঃ ই.এ. চৌধুরী সাহেব ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আহত, ক্ষত-বিক্ষত সিপাহীদের দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । লাইনে মুহূর্তের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল । তিনি লাইনের মধ্যে প্রবেশ করে প্রতিটি সিপাহীর আহত, ক্ষত-বিক্ষত দেহ দেখলেন, তার দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিল । তিনি অবিলম্বে আমাদের খাওয়া ব্যবস্থা করলেন । তিনি বললেন "তোমাদের কোন অসুবিধা নাই, তোমরা নীরবে তোমাদের কাজ করে যাও । আমি তোমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখবো ।"
আমার সাথে আমার আরও তিনজন সুবেদার, সুবেদার সফিকুর রহমানের সহকর্মীর সাথে আটজন হাবিলদার - মোঃ ফজলুল হক, আঃ ওয়াদুদ, আব্দুল কুদ্দুস ও অন্যান্য বিশজন কনস্টেবল দিয়ে ঢাকা কোতোয়ালী থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় । আমরা থানায় প্রবেশ করে দেওয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেলাম, দেখলাম থানার দেওয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে, বুড়ীগঙ্গার পাড়ে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ দেখলাম, আমাদের পি.আর.এফ.-এর কনস্টেবল আবু তাহেরের (নং ৭৯৮) পোশাকপরা লাশ ভাসছে, আরও বহু সিপাহীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখতে পেলাম । আমার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছিল, আমি দিশাহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার প্রিয় সিপাহী তাহেরের লাশ ধরতে গেলে পিছন থেকে এক পাঞ্জাবী সেনা গর্জন করে কর্কশভাবে বলতে থাকে "শুয়র কা বাচ্চা, তোমকো ভি পাকড়াতা হ্যায়, কুত্তা কা বাচ্চা, তোম কো ভি সাথ মে 'গুলি করেগা' ।" আমি আর্মি সাব-ইন্সপেক্টর হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ পাকসেনা আমার সাথে কুকুরের মত ব্যবহার করল । দুঃখে, অপমানে, লজ্জায় আমি যেন অবশ হয়ে পড়লাম । প্রতিবাদ করতে চাইলাম সর্বশক্তি দিয়ে কিন্তু পারলাম না । প্রতিবাদ করার কোন উপায় ছিল না । তাই ওদের অশ্য আপত্তিকর কার্যকলাপের প্রতিবাদ করি নাই, সবকিছু নীরবে সহ্য করেছি ওদের যথেচ্ছ কার্যকলাপের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছি ।
কোতোয়ালী থানার বরাবর সোজাসুজি গিয়ে বুড়ীগঙ্গার লঞ্চঘাটের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বুড়ীগঙ্গার পাড়ে লাশ, বিকৃত, ক্ষত-বিক্ষত, অসংখ্য মানুষের লাশ ভাসছে, ভাসছে পুলিশের পোশাকপরা বীভৎস লাশ । দেখলাম বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর অসংখ্য লাশ । যতদূর আমার দৃষ্টি যায় দেখলাম বাদামতলীঘাট থেকে শ্যামবাজারঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অসংখ্য মানুষের বীভৎস পচা ও বিকৃত লাশ, অনেক উলঙ্গ যুবতীর লাশ দেখলাম, এই পূত পবিত্র বীরাঙ্গনাদের ক্ষতবিক্ষত যোনিপথ দেখে মনে হলো, পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মত ওদের পবিত্র দেহেরে উপর ঝাঁপিয়ে পরে ওদেরকে যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ করে গুলিতে ঝাঁজরা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে । অনেক শিশুর ও ছোট ছোট বালক-বালিকাদের থেতলে যাওয়া লাশ দেখলাম । ওদেরকে পা ধরে মাটিতে আছড়িয়ে মারা হয়েছে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রুভরা চোখে আমি লাশ দেখলাম - লাশ আর লাশ - অসংখ্য নিরীহ বাঙ্গালীর লাশ - প্রতিটি লাশে বেয়নেট ও বেটনের আঘাত দেখলাম, দেখলাম কারও মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আছে, পাকস্থলি সমেত হৃৎপিণ্ড বের করা হয়েছে, পায়ের গিট হাতের কব্জা ভাঙ্গা, ঝুলছে পানিতে ।
সদরঘাট টার্মিনালের শেডের মধ্যে প্রবেশ করে শুধু রক্ত আর রক্ত দেখলাম - দেখলাম মানুষের তাজা রক্ত এই বুড়ীগঙ্গা নদীর পাড়ে । এই টার্মিনাল শেড ছিল ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে ওদের জল্লাদখানা । ওরা বহু মানুষকে ধরে এনে ঐ টার্মিনালে জবাই করে বেটন ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে টেনে হেঁচড়িয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে । অসংখ্য মানুষকে এভাবে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিষ্কার ছাপ দেখতে পেলাম সেই রক্তের স্রোতের মধ্যে । শেডের বাইরের প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলাম অসংখ্য কাক ও শকুন মানুষের সেই রক্তের লোভে ভীড় করেছে ।
সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বের হয়ে পূর্বদিকে পাকসেনাদের সদর আউটপোস্টের দিকে দেখলাম নদীর পাড়ের সমস্ত বাড়িঘর ভস্ম হয়ে ওদের নৃশংসতা ওবীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । দেখলাম রাস্তার পার্শ্বে ঢাকা মিউনিসিপালিটির কয়েকটি ময়লা পরিষ্কার করার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, সুইপাররা হাত পা ধরে টেনে হেঁচড়িয়ে ট্রাকে লাশ উটাচ্ছে, প্রতিটি ঘর থেকে আমাদের চোখের সামনে বহু নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধ-বুড়ার লাশ সুইপাররা টেনে টেনে উঠাচ্ছিল । পাঞ্জাবী সেনারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কুকুরের মত নির্মমভাবে প্রহরা দিচ্ছিল । ভয়ে সন্ত্রাসে আমি আর এগুতে পারলাম না ।
পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে আমি সদরঘাটের কাপড়ের বাজারের নীরব নিথর রাস্তা ধরে সদরঘাট বেপটিস্ট মিশনের চৌরাস্তার সম্মুখ দিয়ে নওয়াবপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম । আমাদের কারো শরীরে পুলিশের পোশাক ছিল না - আমি এবং আমার সাথে আরও দুজন সিপাহী সাধারণ পোশাক পরে দায়িত্ব পালন করছিলাম । কাপড়ের বাজারের চারদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সম্মুখে সর্বত্র বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষের ইতস্ততঃ ছড়ানো বীভৎস লাশ দেখলাম, বহু যুবতী মেয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখলাম । খৃস্টান মিশনারী অফিসের সম্মুখে, সদরঘাট বাস স্টপেজের চারদিকে, কলেজিয়েট হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ, পগোজ হাইস্কুল, ঢাকা জজকোর্ট, পুরাতন স্টেট ব্যাঙ্ক বিল্ডিং, সদরঘাট গির্জা, নওয়াবপুর রোডের সর্বত্র, ক্যাথলিক মিশনের বাইরে এবং ভিতরে আদালত প্রাঙ্গণে বহু মানুষের মৃতদেহ দেখলাম । রাস্তায় রাস্তায় দেখলাম পুলিশের পোশাকপরা বহু মৃতদেহ ।
রায় সাহেব বাজার ব্রিজ পার হয়ে নওয়াবপুর রোডে পা দিয়েই দেখলাম বিহারীদের উল্লাশ ও উন্মত্ত লাফালাফি, ওরা পশুর মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অসংখ্য বাঙ্গালীর লাশ পাড়িয়ে জয়ধ্বনি করে মিছিল করে নওয়াবপুরের রাস্তায় বের হয়ে পড়ছিল । পাঞ্জাবী সেনা কর্তৃক নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যার খুশীতে দেখলাম বিহারীরা রাস্তায় পড়ে থাকা বাঙ্গালীদের লাশের উপর লাথি মারছে, কেউ প্রস্রাব করে দিচ্ছে হাসতে হাসতে, রাস্তায় রাস্তায় বিহারী এলাকায় দেখলাম সরু বাঁশের মাথায় বাঙ্গালী বালক ও শিশুর লাশ বিদ্ধ করে খাড়া করে রাখা হয়েছে । দেখলাম উন্মত্ত বিহারী জনতা রাস্তায় পড়ে থাকা লাশগুলিকে দা দিয়ে কুপিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কেটে আনন্দ করছে, উশৃঙ্খল বিহারী ছেলেরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে উল্লাশ করছে, রাস্তার দুইপার্শ্বে সর্বত্র আগুন আর আগুন দেখলাম । বিহারী জনতা রাস্তার পার্শ্বে প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল, জ্বলছিল বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র পণ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, মূল্যবান জিনিসপত্র । ঠাটারীবাজারের ট্রাফিক ক্রসিংয়ে এসে দেখলাম একটি যুবক ছেলের বীভৎস লাশের উপর পেট ছিঁড়ে বাঁশের লাঠি খাড়া করে, লাঠির মাথায় স্বাধীন বাংলার একটি মলিন পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে । লাশের উপর বাংলার পতাকা ঝুলিয়ে রেখে বিহারী জনতা চারিদিকে দাঁড়িয়ে থেকে হাসছে, উল্লাস করছে । দেখলাম লাশের গুহ্যদ্বার দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে । বিজয় নগরের রাস্তা ধরে আমি শান্তিবাগে আমার কোয়ার্টারে আসছিলাম - দেখলাম তখনও রাস্তার চারিপার্শ্বে ঘরবাড়ি জ্বলছে ।
আমি কোতোয়ালী থানায় দায়িত্ব পালন করতাম, ৩০শে মার্চ কোতোয়ালী থানার মধ্যে আমরা কামরায় প্রবেশ করে দেওয়ালের সর্বত্র চাপ চাপ রক্ত দেখলাম, দেখলাম থানার পায়খানা, প্রস্রাবখানা ও অন্যান্য দেওয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে । ১৯৭১ সনের মার্চ মাসের পর কোতোয়ালী থানার কোন বাঙ্গালী পুলিশকে বাইরে কোন টহলে পাঠানো হতো না, থানায় বসিয়ে রাখা হতো । এক পাঞ্জাবী মেজর আমাদেরকে তদারক করে যেতেন মাঝে মাঝে এসে । ৫ই এপ্রিল আমাদের সবাইকে কোতোয়ালী থানা থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হয় । পুলিশ লাইনে এসে আমাদের ব্যারাক কেন্টিন, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুর ভস্ম ছাই দেখলাম । তিন নম্বর ব্যারাকে প্রবেশ করে আমার দুজন প্রিয় সিপাহীর অগ্নিদগ্ধ লাশ দেখলাম - লাশের পায়ে শুধুমাত্র বুট ছিল, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ সারা দেহ জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিল । আমার প্রিয় সিপাহী জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালামের বীভৎস লাশ দেখে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম । লাশের দিকে মাথা নত করে আমার দুজন বীর সিপাহীকে সালাম জানালাম, অশ্রুসিক্ত নয়নে । পুলিশ লাইনে উত্তর-পূর্বদিকের পুকুরের উত্তর পারে শহীদ সিপাহীদের যথার্থ মর্যাদার সাথে সমাহিত করলাম ।
১৯৭১ সনের মে মাসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী পুলিশ এসে গেলে পাঠান রিজার্ভ ইন্সপেক্টর কুকুরের মত অট্টহাসীতে ফেটে পড়ে বলতে থাকে "যা শালা লোক, শোয়ার কা বাচ্চা, হামারা ব্যারাক ছোড়ো, হামারা আদমী আগিয়া, শালা লোগ, ভাগো" । একথা বলার সাথে সাথে বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান পুলিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র সবকিছু ব্যারাকের বাইরে ফেলে দিয়ে আমাদের ঘাড়ে ধরে বের করে দেয় । আমরা বাঙ্গালী পুলিশরা অসহায় এতিমের মত আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ কুঁড়িয়ে নিয়ে লাইনের আস্তাবলে বারান্দায় গাছের নিচে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আশ্রয় গ্রহণ করি । রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যোগদান করার পর আমরা দেখেছি পাঞ্জাবী সেনারা মিলিটারী ট্রাকে ও জীপে করে প্রতিদিন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বালিকা, যুবতী মেয়ে ও সুন্দরী রমণীদের ধরে আনতে থাকে । অধিকাংশ বালিকা, যুবতী মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখেছি । প্রতিটি মেয়ের মুখমণ্ডল বিষণ্ণ ও বিমর্ষ ও বিষময় দেখেছি । মিলিটারী জীপে ও ট্রাকে যখন এভাবে যুবতী মেয়েদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হত তখন পুলিশ লাইনে হৈ চৈ পড়ে যেত । পাঞ্জাবী, বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ জীভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সম্মুখে এসে মেয়েদের টেনে হেঁচড়িয়ে নামিয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দেহের পোশাক-পরিচ্ছদ কাপড়-চোপড় খুলে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে উলঙ্গ করে আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেলে কুকুরের মত ধর্ষণ করতো । রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল থেকে ধরে এসকল যুবতী মেয়েদের সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর বৈকালে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপর তাদেরকে উলঙ্গ করে চুলের সাথে লম্বা লোহার রডের সাথে বেঁধে রাখা হতো । রাতের বেলায় এসব নিরীহ বাঙ্গালী নারীদের উপর অবিরাম ধর্ষণ চালানো হতো । আমরা গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে বসে মেয়েদের আর্ত চিৎকার শুনে অকস্মাৎ সবাই ঘুম থেকে ছেলেমেয়েসহ জেগে উঠতাম । সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর চিৎকারে কান্নার রোল ভেসে আসতো "বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাদের বাঁচাও, এক ফোঁটা পানি দাও, পানি, পানি !"
মিলিটারী ট্রাক ও ভ্যানে প্রতিদিন পাঞ্জাবী সেনারা রাজধানীর বিভিন্ন জনপদ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে নিরীহ বাঙ্গালী যুবক ছেলেদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে অফিসের কক্ষে কক্ষে জমায়েত করে অকথ্য অত্যাচার চালাতো । হেডকোয়ার্টারে অফিসের উপর তলায় আমাদের প্রবেশ করা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল । দিনের বেলায় পুলিশ লাইনে প্যারেডের আওয়াজের জন্য উপর তলা থেকে নির্যাতিত বন্দীদের কোন আর্তনাদ আমরা শুনতে পেতাম না । সন্ধ্যার পর আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কোয়ার্টার থেকে তাদের আর্তনাদ শুনতে পেতাম । সন্ধ্যার পর পাকসেনারা বিভিন্ন প্রকার বন্দীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যেত । আর লোহার রডের উপর ঝুলন্ত বালিকা, যুবতী নারী ও রূপসী রমণীদের উপর চলতো অবিরাম ধর্ষণ, নির্মম অত্যাচার । বন্দীদের হাহাকারে আমরা অনেক সময় একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়তাম, অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইতাম । কিন্তু ওদের শক্তি মোকাবেলায় আমাদের কিছুই করার ছিল না, আমরা কিছুই করি নাই, করতে পারি নাই । এভাবে প্রতিদিন 'মুক্তি হ্যায়' বলে যে সব নিরীহ বাঙ্গালী ছেলেদের চোখ বেঁধে পুলিশ লাইনে এনে হেডকোয়ার্টার অফিসে জমায়েত করা হতো । রাতের শেষে পরের দিন সকালে আর এ সকল বন্দীদের দেখা যেত না এবং সে স্থানে নতুন বন্দীদের এনে রাখা হতো ।
--x--
পৃঃ৩৭-৩৮ : মোঃ সালেহুজ্জামান - সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ, রমনা থানা, ঢাকা, ৭-২-১৯৭৪
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি এক প্লাটুন ফোর্সসহ মীরপুর এক নম্বর সেকশনে টহলে ছিলাম । সন্ধ্যার পরপরই আমি মীরপুরের সর্বত্র থমথমে ভাব লক্ষ করেছি । রাত আনুমানিক সাড়ে দশটার সময় আমার ওয়ারলেস সেটটি অকস্মাৎ সক্রিয় হয়ে ঊঠে । ওয়ারলেস সেটে এক বাঙ্গালী কণ্ঠ অজানা স্টেশন থেকে বলছিল, "ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাঙ্ক ও কামানবাহী সশস্ত্র পাকসেনাদের ট্রাক সারিবদ্ধভাবে রাজধানীতে সদর্পে প্রবেশ করছে, বাঙ্গালী পুলিশ তোমরা সাবধান হও ।" ইহার পর আমার ওয়ারলেস সেটের মারফত ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে মেসেজ দেওয়া হয়, "পুলিশ ডিউটি উইথড্রন" (Police-duty withdrawn) । ওয়ারলেস মারফর এসব মেসেজ আসার পরপরই আমি ঢাকা রাজধানীর আকাশে সর্বত্র আগুনের ফুলকি উঠতে দেখলাম । অকস্মাৎ রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইকবাল হল, ই.পি.আর. হেডকোয়ার্টারে ভীষণ কামান ও ট্যাঙ্ক হামলার আকাশফাটা শব্দ শুনতে পাই । এ পরিস্থিতিতে আমি আমার টহলরত পুলিশ ফোর্শকে মীরপুরের পশ্চিম দিকে গ্রামের দিকে চলে গিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়ে আমি আমার রাইফেল ও গুলি নিয়ে থানার বাসায় চলে যাই । থানায় ফিরে এসে আমি তৎকালীন মীরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ আবুল হাসেম এবং অন্যান্য সাব-ইন্সপেকটর, এ.এস.আই. ও বাঙ্গালী পুলিশদের অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিমূঢ় দেখতে পাই । থানায় বসে আমরা ওয়ারলেসে বাঙ্গালী কণ্ঠের বহু বীভৎস আর্তনাদ শুনতে পাই । রাত সাড়ে চারটার দিকে পাক পশুরা পুলিশ কন্ট্রোল রুম দখল করে সেখানকার ওয়ারলেসে বাইরে টহল নিযুক্ত বাঙ্গালী পুলিশদের কর্কশ কণ্ঠে বলছিল "বাঙ্গালী শালালোগ, আভী আ-কার দেখো, তোমহারা কেতনা মা বাহেন হামারা পাস হ্যায়, ... ।" একথা শুনে আমাদের বাঙ্গালী পুলিশদের গা শিউরে উঠে । আমি তৎক্ষণাৎ ওয়ারলেস সেট বন্ধ করে দেই । সকাল হওয়ার পূর্বেই আমি থানা ও থানার বাসা ছেড়ে দিয়ে মীরপুরে অন্য এক বাসায় আত্মগোপন করে থাকি ।
সকালে আমি দেখলাম বাঙ্গালী ই.পি.আরদের মীরপুর ই.পি.আর. ক্যাম্প থেকে বন্দী করে আমাদের থানার সম্মুখে এনে পাক পশুরা নিরস্ত্র করে থানায় বন্দী করছে । আমি আরও দেখলাম মীরপুরের সকল বাঙ্গালী বাড়ীতে বিহারীরা কপালে সাদা কাপড় বেঁধে দানবের মত উল্লাসে ফেটে পড়ে আগুন লাগাচ্ছে, লুটপাট করছে । বাড়ী বাড়ী থেকে বাঙ্গালী শিশু, যুবতী, বৃদ্ধাদের টেনে এনে রাস্তায় রাস্তায় ফেলে ছোড়া দিয়ে জবাই করছে, বাঙ্গালী রমণীদের ধরে এনে রাস্তায় উলঙ্গ করে ফেলে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস ছলাৎ করে কেটে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করছে । কাউকে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলছে, কারও যোনিতে লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কারও গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে । ভীত-সন্ত্রস্ত হাজারো মানুষ তখন প্রাণ ভয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল । যে সকল নিরীহ মানুষ পালাতে পারছিল না তাদেরকে বিহারীরা নির্মমভাবে জবাই করছিল । পাকসেনারা এ ব্যাপক বাঙ্গালী হত্যায় বিহারীদের পিছনে থেকে সাহায্য করছিল ।
২৭শে মার্চ সকালে কিছুক্ষণের জন্য কার্ফু তুলে নিলে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মীরপুরের বাইরে যাত্রা করি । মীরপুর গরুর হাট অতিক্রম করার সময় আমি দেখলাম পাকসেনাদের টহল ভেদ করে একটি ট্রাকে মহিলা ও শিশু মীরপুর ব্রীজের দিকে যাচ্ছিল - পাকসেনারা ঐ ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় । আর দুটি যুবতী মেয়েকে তাদের জীপে উঠিয়ে নিয়ে যায় । মেয়ে দুটি পাক পশুদের হাতে পড়ে প্রাণফাটা চিৎকারে আর্তনাদ করছিল । আমরা দূর থেকে গরুর হাট বরাবর বোরো ধানের ক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছিলাম । বহু দুর্দশা ও লাঞ্ছণা ভোগ করে আমি আট দিন পায়ে হেঁটে ও নৌকাযোগে দেশের বাড়ীতে পৌঁছি ।
--x--
পৃঃ৪৫-৪৭ : পরদেশী ডোম - সুইপার (পিতা - ছোটন ডোম), সরকারী পশু হাসপাতাল, ঢাকা, ২১-৩-১৯৭৪
১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাকসেনাদের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান শূরের প্রশাসনিক অফিসার মিঃ ইদ্রিস পৌরসভার আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি মিউনিসিপ্যাল ট্রাকে পশু হাসপাতালের গেটে এসে বাঘের মত "পরদেশী, পরদেশী" বলে গর্জন করতে থাকলে আমি ভীত-সন্ত্রস্তভাবে আমার কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি । ইদ্রিস সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে কর্কশ স্বরে বলতে থাকেন, "তোমরা সব সুইপার ডোম বের হও, যদি বাঁচতে চাও অবিলম্বে সবাই মিলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তূপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও । নইলে কাউকে বাঁচানো হবে না, কেউ বাঁচতে পারবে না ।" পৌরসভার সেই ট্রাকে নিম্নবর্ণিত সুইপাররা বসা ছিল : ১)ভারত, ২)লাডু, ৩)কিষণ ।
আমি তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম । সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে আমাদের প্রায় আঠারজন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সাথে দুইজন সুইপার ইন্সপেক্টর আমাদের সুপারভাইজার নিয়োজিত করে তিন ট্রাকে তিনদলকে বাংলাবাজার, মিটফোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয় । আমি মিটফোর্ডের ট্রাকে ছিলাম । সকাল নয়টার সময় আমাদের ট্রাক মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বুকে এবং পিঠে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা করা প্রায় একশত যুবক বাঙ্গালীর বীভৎস লাশ দেখলাম । আমি আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে লাশ ঘরের ভিতর প্রবেশ করে প্রতিটি লাশের পায়ে ধরে টেনে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে উঠাবার জন্য । আমি দেখেছি প্রতিটি লাশের বুক ও পিঠ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা । সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া একটি লাশের উপর থেকে চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম একটি রূপসী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ - লাশের বক্ষ, যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত, কোমরের পিছনের মাংস কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মত মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো, আমি কিছুতেই চোখের পানি রাখতে পারলাম না । আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যত্ন সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম ।
মিটফোর্ডের লাশ ঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম । দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমেরা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে । আমি অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখি নাই, যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো তার কোন লাশের দেহেই আমি কোন আবরণ দেখি নাই । তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পিছন দিক সহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে ।
দুপুর প্রায় দুটার সময় আমরা রমনা কালিবাড়ীতে চলে আসি পৌরসভার ট্রাক নিয়ে । লাশ উঠাবার জন্য ট্রাক রমনা কালিবাড়ীর দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে, দুজন ট্রাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালিবাড়ীর ভিতরে গিয়ে দেখি সবকিছু পুড়ে ভস্ম হয়ে আছে ।কালিবাড়ীর ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো ৪১টি পোড়া লাশ আমি ট্রাকে তুলেছি । কালিবাড়ীর এসকল লাশ আমরা ধলপুরের ময়লার ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি । লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলি বের হতে চাচ্ছিল । পরের দিন আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই, যেতে পারি নাই, সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কোন কিছু স্পর্শ করতে পারি নাই ।
পরের দিন ২৯শে মার্চ সকালে আমি আবার ঢাকা পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে ঢাকা শাঁখারীবাজারে যেতে বলা হয় । জজ কোর্টের সম্মুখে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও জ্বলছিল, আর পাকসেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারীবাজারে প্রবেশ করতে পারি নাই । পাটুয়াটুলি ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাঁখারীবাজারের মধ্যে প্রবেশ করল । ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রবেশ করলাম - দেখলাম মানুষের লাশ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, কিশোর শিশুর বীভৎস পচা লাশ, চারদিকে ইমারতসমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে । কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো আছে । বহু পোড়া, ভস্ম লাশ দেখেছি । পাঞ্জাবী সেনারা পাষণ্ডের মত লাফাতে লাফাতে গুলিবর্ষণ করছিল, বিহারী জনতা শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারীবাজারে প্রবেশ করার সাহস পাই নাই ।
৩০শে মার্চ সকালে আমার দলকে মিলব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হয় । আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বহু লাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম, প্রতিটি রশির বন্ধন খুলে প্রতি দলে দশ জন পনের জনের লাশ বের করলাম, সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম । প্রতিটি লাশের চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা শক্ত করে পিছন দিক থেকে । প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে । লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম । লাশের কোন দলকে দেখলাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁজরা হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারো মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারো কাটা হৃৎপিণ্ড বের হয়ে আছে । নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষত-বিক্ষত, উলঙ্গ লাশ দেখলাম । চোখ বাঁধা, হাত, পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা, মুখমণ্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম । দুইবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি ।
এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয় । আমি উপরোক্ত এলাকার নদীর ঘাট থেকে পঁচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি । আমি যেদিন কালিবাড়ী লাশ তুলেছি সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনে স্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে আমি লাশ তুলেছি । রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর থেকে আমি যেয়ে পুরুষ ও শিশু সমেত নয়টি লাশ তুলেছি । আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর পেচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি ।
--x--
পৃঃ৪৮-৫১ : রাবেয়া খাতুন - সুইপার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা, ১৮-২-১৯৭৪ [পাকিস্তানীদের বর্বরতা]
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাঞ্জাবী সেনারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় তখন আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস.এফ. ক্যান্টিনে ছিলাম । আসন্ন হামলার ভয়ে আমি সারাদিন পুলিশ লাইনের ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে রাতে ব্যারাকেই ছিলাম । কামান, গোলা, লাইট বোম আর ট্যাঙ্কের অবিরাম কানফাটা গর্জনে আমি ভয়ে ব্যারাকের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে থেকে থর থরিয়ে কাঁপছিলাম । ২৬ মার্চ সকালে ওদের কামানের সম্মুখে আমাদের বীর বাঙালি পুলিশ বাহিনী বীরের মতো প্রতিরোধ করতে করতে আর টিকে থাকতে পারেনি । সকালে ওরা পুলিশ লাইনের এস.এফ. ব্যারাকের চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে । বাঙালি পুলিশের নাকে মুখে সারা দেহে বেয়নেট বেটন চার্জ করতে করতে বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসছিল ।
ক্যান্টিনের কামরা থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনা হয় । আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া হয় এবং আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল । আমার উপর উপর্যুপরি অত্যাচার করতে করতে যখন আমাকে একেবারে মেরে ফেলার উপক্রম হয় তখন আমার বাঁচার আর কোনো উপায় না দেখে আমি আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওদের নিকট কাকুতি মিনতি জানাচ্ছিলাম । আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরো না, আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করার কেউ থাকবে না, তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা আমাকে মেরো না, মেরো না, মেরো না! আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পুলিশ লাইন রক্ত ও লাশের পঁচা গন্ধে মানুষের বাস করার অযোগ্য হয়ে পড়বে ।
তখনো আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, কুকুরের মতোই আমার কোমরের উপর চড়াও হয়ে আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল । আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেলে দিলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পরিষ্কার করার জন্য আর কেউ থাকবে না একথা ভেবে আমাকে এক পাঞ্জাবী সেনা ধমক দিয়ে বলতে থাকে, 'ঠিক হায়, তোমকো ছোড় দিয়া যায়েগা জারা বাদ, তোম বাহার নাহি নেকলেগা, হার ওয়াকত লাইন পার হাজির রাহেগা ।' একথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয় ।
পাঞ্জাবী সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙালি যুবতী মেয়ে, রূপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জামায়েত করতে থাকে । আমি ক্যান্টিনের ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম, দেখলাম আমার সম্মুখ দিয়ে জিপ থেকে আর্মি ট্রাক থেকে লাইন করে বহু বালিকা, যুবতী ও মহিলাকে এস.এফ. ক্যান্টিনের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে রাখা হলো । বহু মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপর তলার রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, আর অবশিষ্ট মেয়ে যাদেরকে ব্যারাকের ভেতরে জায়গা দেয়া গেলো না তাদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হলো । অধিকাংশ মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখলাম, তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিলো ।
এরপরই আরম্ভ হয়ে গেল সেই বাঙালি নারীদের উপর বীভৎস ধর্ষণ । লাইন থেকে পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মক্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে প্রবেশ করতে লাগলো । ওরা ব্যারাকে প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী, মহিলা ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লেগে গেল । কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই নিরীহ বালিকাদের উপর ধর্ষণে লেগে গেল । আমি ব্যারাকে ড্রেন পরিষ্কার করায় অভিনয় করছিলাম আর ওদের বীভৎস পৈশাচিকতা দেখছিলাম । ওদের উন্মত্ত উল্লাসের সামনে কোনো মেয়ে কোনো শব্দ পর্যন্তও করে নাই, করতে পারে নাই । উন্মত্ত পাঞ্জাবী সেনারা এই নিরীহ বাঙালি মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয় নাই, আমি দেখলাম পাক সেনারা সেই মেয়েদের পাগলের মতো উঠে ধর্ষণ করছে আর ধারালো দাঁত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে । ওদের উদ্ধত ও উন্মত্ত কামড়ে অনেক কচি মেয়ের স্তনসহ বক্ষের মাংস উঠে আসছিল । মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বক্ষ, পিঠের ও কোমরের অংশ ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে গেল ।
যে সকল বাঙালি যুবতী ওদের প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করল দেখলাম তৎক্ষণাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদেরকে চুল ধরে টেনে এনে স্তন ছোঁ মেরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বীরঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল । অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজন দু'পা দু'দিকে টেনে ধরে চড় চড়িয়ে ছিড়ে ফেলে দিল, আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে, আর ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম । পাঞ্জাবীরা মদ খেয়ে খেয়ে কুকুরের মতো যার যে মেয়ে ইচ্ছা তাকেই ধরে ধর্ষণ করছিল ।
শুধু সাধারণ পাঞ্জাবী সেনারাই এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয়নি । সকল উচ্চ পদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররা মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মতো হয়ে দুই হাত বাঘের মত নাচাতে নাচাতে সেই উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙালি নারীদের ওপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ কাজে লিপ্ত থাকতো । কোনো মেয়ে-নারী-যুবতীকে এক মুহূর্তের জন্য অবসর দেয়া হয়নি । হানাদারদের উপর্যুপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানে রক্তাক্ত দেহে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে । পরের দিন এই সকল মেয়ের লাশ অন্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত । এ সকল নারী, বালিকা ও যুবতীর নির্মম পরিণতি দেখে অন্য মেয়েরা আরো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো এবং স্বেচ্ছায় পশুদের ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো ।
যে সকল মেয়েরা প্রাণের ভয়ে বাঁচার জন্য ওদের সঙ্গে মিল দিয়ে ওদের অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য সর্বোতভাবে সহযোগিতা করে তাদের পেছনে ঘুরে বেরিয়েছে তাদের হাসি তামাশায় দেহ-মন দান করেছে তাদেরকেও ছাড়া হয় হয় নাই । পদস্থ সামরিক অফিসাররা সেই সকল মেয়েদের উপর সম্মিলিতভাবে ধর্ষণ করতে করতে হঠাৎ একদিন তাকে ধরে ছুরি দিয়ে তার স্তন কেটে পাছার মাংস কেটে, যোনি ও গুহ্যদারের মধ্যে সম্পূর্ণ ছুরি চালিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তারা আনন্দ উপভোগ করতো ।
এরপর উলঙ্গ মেয়েদেরকে গরুর মতো লাথি মারতে মারতে পিটাতে পিটাতে উপরে হেডকোয়ার্টারের দোতলা, তেতালা ও চার তলায় উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় । পাঞ্জাবী সেনারা চলে যাবার সময় মেয়েদেরকে লাথি মেরে আবার কামরার ভেতরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে চলে যেত । এরপর বহু যুবতী মেয়েকে হেডকোয়ার্টারের উপর তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের উপর চুলের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় । প্রতিদিন পাঞ্জাবীরা সেখানে যাতায়াত করতো । সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কেউ এসে তাদের উলঙ্গ দেহের কোমরের মাংস বেটন দিয়ে উন্মত্তভাবে আঘাত করতে থাকতো, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেতো, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যোনিপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো । কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোনো যুবতীর পাছার মাংস আস্তে আস্তে কেটে কেটে আনন্দ করতো । কেউ উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত বক্ষ স্তন মুখ লাগিয়ে ধারাল দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস তুলে নিয়ে আনন্দে অট্টহাসি করতো । কোনো মেয়ে এসব অত্যাচারে কোনো প্রকার চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার যোনিপথ দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হতো । প্রতিটি মেয়ের হাত বাঁধা ছিল ও পেছন দিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল । অনেক সময় পাঞ্জাবী সেনারা সেখানে এসে সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতারি বেদম প্রহার করে যেতো ।
প্রতিদিন এভাবে বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের দেহের মাংস কেটে রক্ত ঝরছিলো, মেয়েদের কারো মুখের সম্মুখের দাঁত ছিল না । ঠোঁটের দুদিকের মাংস কামড়ে টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছিল । লাঠি ও লোহার রডের অবিরাম পিটুনিতে প্রতিটি মেয়ের আঙ্গুল হাতের তালু ভেঙ্গে থেতলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল । এসব অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত নারী ও মেয়েদের প্রস্রাব ও পায়খানা করার জন্য হাতের ও চুলের বাঁধন এক মুহূর্তের জন্যও খুলতে দেয়া হতো না । হেডকোয়ার্টারের উপর তলায় বারান্দায় এই ঝুলন্ত মেয়েরা হাত বাধা অবস্থায় লোহার তারে ঝুলে থেকে সামনে পায়খানা-প্রস্রাব করতো । আমি প্রতিদিন গিয়ে এসব পায়খানা পরিষ্কার করতাম ।
আমি স্বচক্ষে দেখেছি অনেক মেয়ে অবিরাম ধর্ষণের ফলে নির্মমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে । প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই বাধন থেকে অনেক বাঙালি যুবতীর বীভৎস মৃতদেহ পাঞ্জাবী সেনাদের নামাতে দেখেছি । আমি দিনের বেলায়ও সেখানে সব বন্দি নারীদের পূত গন্ধ প্রস্রাব পায়খানা পরিষ্কার করার জন্য সারাদিন উপস্থিত থাকতাম । প্রতিদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাক থেকে এবং হেডকোয়ার্টারের অফিসের উপর তলা হতে বহু ধর্ষিতা মেয়ের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ ওরা পায়ে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যেত এবং সেই জায়গায় রাজধানী থেকে ধরে আনা নতুন নতুন মেয়েদের চুলের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে ধর্ষণ আরম্ভ করে দেয় । এসব উলঙ্গ নিরীহ বাঙালি যুবতীদের সারাক্ষণ সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা প্রহরা দিত । কোনো বাঙালিকেই সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না । মেয়েদের হাজার কাতর আহাজারিতেও আমি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি মেয়েদের বাঁচাবার জন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারি নাই । এপ্রিল মাসের দিকে আমি অন্ধকার পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে খুব ভোরে হের্ডকোয়ার্টারের উপর তলায় সারারাত ঝুলন্ত মেয়েদের মলমূত্র পরিষ্কার করছিলাম । এমন সময় সিদ্ধেশ্বরীর ১৩৯ নং বাসার রানু নামে এক কলেজের ছাত্রীর কাতর প্রর্থনায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়ি এবং মেথরের কাপড় পরিয়ে কলেজ ছাত্রী রানুকে মুক্ত করে পুলিশ লাইনের বাইরে নিরাপদে দিয়ে আসি । স্বাধীন হওয়ার পর সেই মেয়েকে আর দেখি নাই ।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত পাঞ্জাবী সেনারা এ সকল নিরীহ বাঙালি মহিলা, যুবতী ও বালিকাদের উপর এভাবে পাশবিক অত্যাচার ও বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে যাচ্ছিল । ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় বোমা বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবী সেনারা আমাদের চোখের সামনে মেয়েদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে । রাজারবাগ হেডকোয়ার্টারের উপর তলায় সমস্ত কক্ষে বারান্দায় এই নিরীহ মহিলা ও বালিকাদের তাজা রক্তে জমাট বেঁধেছিল । ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী রাজধানীতে বীর বিক্রমে প্রবেশ করলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল পাঞ্জাবী সেনা আত্মসমর্পণ করে ।
--x--
আর টাইপ করতে পারলাম না ... বীভৎসতায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা জার্মান বা জাপানীদেরকেও ছাপিয়ে গেল, বেলুচিস্তানে আজও এই পশুগুলো অত্যাচার করে চলেছে অথচ এদের কোন বিচার হয় না ! কেন ?
No comments:
Post a Comment